আজ শিক্ষক দিবসে অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। বিদ্যালয় জীবনে এক বিদ্যালয়ে শিশু বিভাগ, অপর এক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক বিভাগ কাটিয়ে, অবশেষে বাড়ি থেকে একটু দূরে যাদবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য ওই বিদ্যালয়ের খুব সুনাম। বিদ্যালয়ের সুনাম ধরে রাখার জন্য শিক্ষকরা খুব যত্নবান । কেউ কেউ একটু হয়তো বা বেশী। তখন অনেক শিক্ষকের ধারণা ছিল , গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হতেই পারে। অঙ্কের শিক্ষক রাম স্যার তাদের একজন।প্রচুর পরিশ্রম করে অঙ্ক জলের মত বোঝাতেন। তার ধারণা এর মধ্যে না বোঝার মত বিষয় কিছুই নেই। কিন্তু কিছু অমনোযোগী ছাত্র সব সময়েই থাকে। তারা ক্লাসে করতে পারত না। ব্যাস। শুরু হয়ে গেল ডান হাতের মধ্যম আঙুল পাকিয়ে নিয়ে গাঁট্টা। যতক্ষণ না অঙ্ক মাথায় ঢুকবে , বা সঠিক উত্তর বলতে পারবে , গাঁট্টা থামবে না। শেষে এই গাঁট্টা খেকোদের দল ছড়া বাঁধল
রাম স্যরের গাঁট্টা
আট আনায় আটটা।
তবে এই গাঁট্টা খেকোদের কেউ কেউ পরে অঙ্কের শিক্ষক হয়েছেন। তারা এসে স্যরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছেন, স্যর আপনার গাঁট্টা না খেলে আমার অঙ্কের শিক্ষক হওয়া হতো না।
রসায়ন পড়াতেন সুধীর স্যর । ওনার পড়ানোর ধরণটা ছিল পরীক্ষার্থীদের আরো কিভাবে বেশী নম্বর পাওয়ানো যায়, তার দিকে লক্ষ রেখে। বিষয় বুঝিয়ে দেওয়ার পরে চলত সঠিক উত্তর লেখার রিহার্সাল । কত নম্বরের প্রশ্ন এলে কতটা লিখতে হবে, বইতে লাইনের নীচে দাগ দিয়ে দিয়ে , পাখী পড়ার মত করে উনি বার বার বোঝাতেন। অনাদি মল্লিক স্যর পড়াতেন ইংরেজি। শুধু পড়ানো বা লেখানো নয়, ইংরেজি উচ্চারণ যাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, তার জন্য প্রত্যেক ছাত্রকে দিয়ে একেকটা লেখার অংশবিশেষ পড়াতেন। ছাত্রদের জিজ্ঞেস করতেন , কার উচ্চারণ শুনতে ভাল লাগছে, কার ততো ভাল লাগছে না। তারপর এর কারণ ব্যাখ্যা করতেন। আমার ইংরেজি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ মল্লিক স্যরের শেখানোর পদ্ধতি। আদিত্য চট্টোপাধ্যায় স্যর পড়াতেন বাংলা। দীর্ঘ দেহী, জোব্বার মত একটা পোষাক পড়া , সাদা চুল, দাড়িতে ওনাকে ঋষি বলেই মনে হত। ইস্কুলে ওনার চলতি নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ । ওনার বাংলা ব্যাকরণের উপর গবেষণালব্ধ বই ছিল। তিনি কোনদিনও নিজের বইকে ইস্কুলের সিলেবাসের অবশ্যপাঠ্য করার চেষ্টা করেন নি। অন্যান্য ইস্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকারা ওনার কাছ থেকে বাংলা ব্যাকরণ বুঝতে আসতেন। তখন জানতে পারলাম ওনার বইয়ের কথা। সুবোধ স্যর ছিলেন আরেকজন বাংলা ভাষার শিক্ষক । উনি ভাষা শিক্ষাদানের সঙ্গে আমাদের নিয়ে যেতেন বিভিন্ন বিতর্ক সভায়। ইস্কুলে অভ্যন্তরীণ বিতর্কে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর ভাগ্যে জুটত ইস্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করার ভার। সাধারণ ভাবে এই প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব বর্তাত, আমার বন্ধু চৈতন্য ( এখন প্রখ্যাত চর্ম চিকিৎসক ডা, চৈতন্য ঘোষ ) আরেক বন্ধু জোয়ারদার বা আমার উপর। বহু বিতর্ক সভায় সুবোধ স্যরের সঙ্গে গেছি এবং পক্ষে বা বিপক্ষে বলেছি। আরও অনেক শিক্ষকের কথা ভিড় করে আসছে। যেমন, বাংলায় কানাই স্যর, অংকে হীরেন স্যর, পদার্থবিদ্যায় নির্মল স্যর, রসায়নে অনঙ্গ স্যর, জীববিজ্ঞানে গোপী স্যর যার সঙ্গে আমাদের দল বেঁধে দীঘা বেড়াতে যাওয়া, ল্যাবরেটরির স্পেসিমেন সংগ্রহ করতে। এদের প্রত্যেকেরই পড়ানোর পদ্ধতি ছিল আলাদা। আজকে শিক্ষক দিবসে এনাদের সবার ঋণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।